রক্ত মানবদেহের অপরিহার্য ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পূর্ণমাত্রায় রক্ত থাকলে মানবদেহ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তশূণ্যতা দেখা দিলেই শরীর অকেজো ও দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রাণশক্তিতে ভাটা পড়ে। সুতরাং রক্ত হচ্ছে মানুষের জীবনীশক্তির মূল। জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বলা হয়, ” রক্ত দিন, জীবন বাঁচান”। তবে অনেকে রক্তদান করতে ভয়ভীত হন এই ভেবে যে, তারা রক্ত দান করলে, তাদের শরীরে হয়তো রক্ত ঘাটতি সৃষ্টি হবে, এতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। দেহের ওজনের বিবেনায়, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দেহে গড়পরতা পাঁচ লিটার রক্ত থাকে। প্রতিবার রক্তদানের সেশনে ৫০০ মিলিলিটার করে রক্ত নেওয়া হয়। আর রক্তদানের ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নতুন রক্ত তৈরি হয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে।
এখন আমাদের জিজ্ঞাসু মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, দেহে নতুন রক্ত তৈরি হয় কীভাবে আর তৈরিই বা হয় কোথায় ? দেহে কি তাহলে রক্ত তৈরির কারখানা আছে নাকি ? হ্যাঁ, দেহে রক্ত তৈরির বিশাল কারখানা আছে, সেই কারখানা হচ্ছে অস্থিমজ্জা। অস্থিমজ্জা হচ্ছে আমাদের অস্থির কেন্দ্রের গহ্বরে অবস্থিত নরম টিস্যু। গড়ে মানুষের দেহভারের ৪% অস্থিমজ্জা। ৬৫ কেজি ওজনের মানুষের অস্থিমজ্জান পরিমাণ প্রায় ২.৬ কেজি।
এই অস্থিমজ্জাতে দুই ধরনের স্টেম কোষ পাওয়া যায়, সেই স্টেম কোষগুলো হচ্ছে হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ এবং মেসেনকাইমাল স্টেম কোষ। এই স্টেম কোষগুলো আমাদের দেহে অবস্থিত থেকে, দেহের কোন কোষ মারা গেলে বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে সেই কোষগুলোকে সরিয়ে সেই জায়গায় নতুন কোষ তৈরি করে আমাদের সুস্থ রাখে। হেমাটোপয়েসিস অর্থাৎ রক্ত তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত স্টেম কোষগুলোকে হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ বলে। অস্থিমজ্জা যদি রক্ত তৈরির কারখানা হয়ে থাকে, তবে হেপাটোপয়েটিক স্টেম কোষগুলো সেই কারখানার মেশিন। এই হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষগুলো মাল্টিপোটেন্ট ধরনের। মাল্টিপোটেন্ট কি বুঝলেন না তো? যেমন ধরেন রক্তের স্টেম কোষ বা হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ , সব রকমের রক্ত কণিকা বানাতে পারে। অন্যদিকে, নিউরাল স্টেম কোষও মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষ, যা স্নায়ুতন্ত্রের সব কোষগুলোকে তৈরি করে। কিন্তু যত ধরণের কোষই তৈরী করুক না কেন, রূপান্তরের সময় মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষ নিজের টিস্যু বা কলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ নিউরাল স্টেম কোষ কখনও পেশীর কোষে রূপান্তরিত হবে না বা রক্তের স্টেম কোষ কখনও হৃদযন্ত্রের কোষে রূপান্তরিত হবে না। এই মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষগুলো দেহের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া গেছে, যেমন - মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, পেশী, মজ্জা, পেরিফেরাল রক্ত, রক্তনালী, চামড়া, কঙ্কাল পেশী, দাঁত, অন্ত্র, যকৃৎ, ডিম্বাশয়, শুক্রাশয়। সুতরাং মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষ এমন এক ধরনের কোষ, তারা যে নির্দিষ্ট টিস্যু বা অঙ্গে উপস্থিত থাকে, সেই টিস্যু বা অঙ্গেরই একাধিক প্রকার কোষ তৈরি করে।
সৌজন্যে : Adult stem cells — Science Learning Hub
অস্থিমজ্জার এই হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষগুলো আবার দুই ধরনের কন্যা স্টেম কোষ তৈরি করে - মাইলয়েড এবং লিম্ফয়েড স্টেম কোষ। এই ধরনের কন্যা স্টেম কোষকে অলিগোপোটেন্ট স্টেম কোষ বলে। অলিগোপোটেন্ট স্টেম কোষের রূপান্তরের ক্ষমতা মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষের তুলনায় আরো বেশী সীমাবদ্ধ। তারা খুব কম সংখ্যক কোষ তৈরি করতে পারে। মাল্টিপোটেন্ট স্টেম কোষ ১০ ধরনের কোষ তৈরি করতে পারলে, অলিগোপোটেন্ট স্টেম কোষ সেখানে ৩ ধরনের কোষ তৈরি করতে পারে।
মাইলয়েড স্টেম কোষ রক্তের লোহিত রক্তকণিকা, অণুচক্রিকা এবং নিউট্রোফিলস, ইসিনোফিলস এবং বেসোফিলের মতো শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে।
লোহিত রক্তকণিকা - যা শরীরে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে।
অনুচক্রিকা - কাটা স্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
নিউট্রোফিলস, ইসিনোফিলস এবং বেসোফিল - যা পরজীবী সংক্রমণে প্রতিক্রিয়া জানায়।
লিম্ফয়েড স্টেম কোষ, দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত প্রাকৃতিক ঘাতক কোষ, বি-লিম্ফোসাইট এবং টি-লিম্ফোসাইটের মতো শ্বেত রক্তকনিকা তৈরি করে।
প্রাকৃতিক ঘাতক কোষ - যা ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত কোষগুলোকে সরাসরি আক্রমণ করে।
বি-লিম্ফোসাইট - যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এমন অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডি হল দেহে বহিরাগত পদার্থের বা প্রতিরক্ষা-উদ্দীপকের (অ্যান্টিজেন) উপস্থিতির প্রত্যুত্তর হিসেবে দেহের অনাক্রম্যতন্ত্র (তথা প্রতিরক্ষাতন্ত্র) কর্তৃক উৎপন্ন এক ধরনের ইংরেজি ওয়াই-আকৃতির (গুলতির মত দেখতে) প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন জাতীয় পদার্থ।
টি-লিম্ফোসাইট - যা পররজীবী সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরাসরি জড়িত।
এখন আসা যাক, মেসেনকাইমাল স্টেম কোষের প্রসঙ্গে। মেসেনকাইমাল স্টেম কোষগুলো কিন্তু রক্তকোষ গঠনে কোন অবদান রাখে না। এই স্টেম কোষগুলো মূলত আমাদের রক্ত তৈরির কারখানাকে দেখভাল করে, বলতে পারেন আমাদের রক্তের কারখানার কেয়ারটেকার। তারা আসলে কঙ্কাল টিস্যুর বিভিন্ন কোষ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ- তারা কার্টিলেজ কোষ ( কন্ড্রোসাইটস ), হাড়ের কোষ ( অস্টিওবøাস্ট ) এবং ফ্যাট কোষ ( অ্যাডিপোসাইটস ) তৈরি করতে পারে। আর এরাই সারা শরীর জুড়ে সংযোজক টিস্যুতে পরিণত হয়।
বুঝতেই পারছেন, অস্থিমজ্জার কর্মকান্ড কেবল রক্ত তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তেমনটা না। তবে অস্থিমজ্জা অন্যান্য আরো কোষ তৈরি করলেও তার প্রধান কাজ রক্তকোষ তৈরি করাই। তাই তো অস্থিমজ্জা রক্ত তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত।
স্বাস্থ্যকর অস্থিমজ্জা সুস্থ শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। অস্থিমজ্জা সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হলে অ্যানিমিয়া, লিউকেমিয়া, লিম্ফোমার মতো অনেক জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।
আপনার অস্থিমজ্জা প্রতিদিন ২০০ বিলিয়নেরও বেশি নতুন রক্তকণিকা তৈরি করে। রক্ত এবং প্রতিরোধক কোষগুলো ক্রমাগত পুনর্নবীকরণ এবং পুনর্জন্ম প্রক্রিয়াগুলোর মধ্য দিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ - লোহিত রক্তকণিকাগুলোর প্রায় ১২০ দিন আয়ু থাকে, আয়ু শেষ হলে অস্থিমজ্জার স্টেম কোষগুলো আবার নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করে। আপনি এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, দেহে নতুন রক্ত তৈরি হয় কীভাবে আর তৈরিই বা হয় কোথায়। তাই নির্দ্বিধায় মানুষের প্রয়োজনে রক্ত দিন। আপনার রক্তের মাধ্যমে আরেকজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে এর মতো মহৎ মানবিক কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা হতে পারে না।
Comments