“তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে আর কিছু নাহি চায় গো ।“
আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি যখন গানটি গুনগুনিয়ে গাই, তখন শান্ত পুকুরে ঠিল ছুড়লে যেমন জলের তরঙ্গগুলো সারা পুকুর ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি আমার হৃদয় শান্ত হয়ে প্রেম তরঙ্গ চিত্ত জুড়ে তরঙ্গায়িত হতে থাকে।কারন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটিতে প্রকৃত প্রেমের ধ্বনি তরঙ্গায়িত করেছেন। যে প্রেমে প্রেমিকের হৃদয়ে না থাকে কোন ভয় আর না থাকে কোন স্বার্থ।কারন সে কোন কিছু পাবার আশায় ভালবাসে না, প্রেমের জন্যই প্রেম করে।
ভয় এবং প্রেম সবসময়ই সাংঘর্ষিক।যেখানে ভয় থাকে, সেখানে কখনো প্রেম বিরাজ করতে পারে না। কারন যেখানে ভয় থাকে, সেখানে কখনো স্বাধীনতা থাকে না। আর যেখানে স্বাধীনতা থাকে না, সেখানে কখনো প্রেম থাকতে পারে না। ক্রীতদাসের পক্ষে প্রেম সম্ভব নয়, কারন তার অন্তরে বিরাজ করে প্রভুর প্রতি ভয়।সাধক কবি কবীর বলেছেন, “ সূর্য্য যেখানে প্রকাশিত সেখানে রাত্রি কোথায়? রাত্রি যদি থাকে সেখানে সূর্য্য আলো দেয় না।যেখানে জ্ঞান প্রকাশিত সেখানে অজ্ঞান কোথায়? অজ্ঞান যদি থাকে তো জ্ঞান সেখানে বিনষ্ট হইয়াছে। “ এখানে প্রেম হচ্ছে জ্ঞান দীপ্ত শিখা আর ভয় রাত্রি স্বরূপ অন্ধকারময় অজ্ঞানতা।
ভয় আসলে কি, তা জানার চেষ্টা করা যাক।ভয় আমাদের মনের ভ্রম মাত্র, যা আগামী দুঃখের কল্পনা, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।কিন্তু এর উৎপত্তি কীভাবে? ভোগবাসনায় মগ্ন মন থেকে ভ্রমের উদ্ভব ঘটে, আর ভ্রম থেকেই ভয়।আমরা যদি আরেকটু গভীরে যাই তাহলে দেখতে পাবো, অহঙ্কারী ব্যক্তির মন পুরোটাই ভয়ের বিচরণ ক্ষেত্র। আর অহঙ্কারী ব্যক্তি যাকে প্রেম মনে করে, তা আসলে প্রেম না মোহ।প্রেম আর মোহের মাঝে পার্থক্য থাকে।
অনেকে হয়তো বলবে ভালবাসা থেকেই তো মোহের জন্ম।বাস্তবে যা প্রেম, তা কোন মোহ নয়। প্রেমের জন্ম করুণা থেকে হয়, আর মোহের জন্ম অহংকার থেকে। প্রেম মুক্তি দেয়, মোহ আবদ্ধ করে। প্রেম বলে, আমি তোমার জীবনের অংশ হতে চাই।আর মোহ বলে, তোমাকে আমার জীবনের অংশ করতে চাই। আসলে প্রেম নিজেকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত করে আর মোহ অন্যকে নিজের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াস করে। পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো, মোহের সৃষ্টি অহংকার থেকে আর অহংকার সৃষ্টি ভয় থেকে।তাই মোহগ্রস্থ ব্যক্তির হৃদয়ে প্রেম বিরাজ করতে পারে না, কারন ভয় ও প্রেম কখনোই একত্র থাকতে করতে পারে না।
অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “ যাহারা ভয়ে ভগবানকে ভালবাসে, তাহারা মনুষ্যাধম। তাহাদের মনুষ্যভাবই পূর্ণ বিকশিত হয়নি।তাহারা শাস্তির ভয়ে ভগবানকে উপাসনা করে।আর ভগবানকে শাস্তির ভয়ে উপাসনা করা অতি নিম্নশ্রেণীর উপাসনা।“ এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ঈশ্বর সম্বন্ধে যাঁর কোন ভয় নাই, তাহলে তাঁর আদর্শ কি? স্বামী বিবেকানন্দ এই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন।উত্তরে বলেছেন, “ তখন তাহার আদর্শ প্রেমজনিত পূর্ণ নির্ভীকতার আদর্শে পরিণত হয়। এই প্রকার সাধকের সর্বোচ্চ আদর্শে কোন প্রকার বিশেষত্ব রূপ সংকীর্ণতা থাকে না।উহা সার্বভৌম প্রেম, অনন্ত ও অসীম প্রেম, উহাই প্রেমের স্বরূপ। প্রেমের এই মহান আদর্শকে তখন সেই সাধক কোনরূপ প্রতীক বা প্রতিমার সহায়তা না লইয়াই উপাসনা করেন।“
স্বামী বিবেকানন্দ মূলত গীতার কথাগুলোই এখানে সুন্দর করে সহজভাবে ব্যাখা করেছেন।শ্রীমদভগবদ গীতার দশম অধ্যায়ের ১০ম শ্লোকটি হচ্ছে -
তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে।
অর্থাৎ, “ নিরন্তন আমার ধ্যানে মগ্ন এবং প্রেমপূর্বক ভজনা করেন যাঁরা, আমি তাঁদের সেই বুদ্ধিযোগ অর্থাৎ যোগে প্রবেশ করতে যে বুদ্ধির প্রয়োজন সেই বুদ্ধি প্রদান করি, যে বুদ্ধি দ্বারা তারা আমাকে লাভ করেন ।“ শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু বলেননি তোমরা আমাকে ভয়পূর্বক উপাসনা করো, তিনি বরং প্রেমময় উপাসনার কথাই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৪৮ তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ আরো বিস্তারিতভাবে বলেছেন, “ রাগ, ভয় এবং ক্রোধরহিত হয়ে অনন্যভাবে আমার শরনাগত বহুলোক জ্ঞানরূপ তপস্যা দ্বারা পবিত্র হয়ে সাক্ষাৎ আমার স্বরূপ লাভ করেছেন।“ আর সেই জ্ঞানরূপ তপস্যা হচ্ছে প্রেমময় ভক্তি, যেখানে ভয়ের কোন স্থান নেই।বর্তমানে ভয়ভীত নিম্নশ্রেণীর উপাসকদের জন্যই সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বহু কুসংস্কার, বিদ্বেষ এবং ধর্ম হয়েছে কলুষিত।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাঁর “হিতোপদেশ“ গ্রন্থে বলেছেন, “আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন- এই চারটি কর্ম মানুষ ও পশুর মধ্যে সমানভাবে বর্তমান। কিন্তু মানুষের অধিকতর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা পারমার্থিক অনুশীলনে নিযুক্ত হতে সক্ষম। অতএব পারমার্থিক জীবন তথা ধর্ম ছাড়া মানুষ পশুর সমান।“ আর প্রেমই মানুষের জীবনকে পারমার্থিক করতে পারে।তাই প্রেমই মানুষেষর ধর্ম। আর ভয় মানুষের এই ধর্মকে বিনষ্ট করে দেয়।
প্রেমের জন্য প্রেম - এতেই মানুষের সর্বোচ্চ সুখ নিহিত। আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের ধরণী একদিন প্রেমময় হয়ে উঠবে, সেখানে থাকবে না কোন হিংসা, বিদ্বেষ, ভয়। থাকবে শুধু প্রেম-প্রীতি।
অপূর্ব পাল
২৩ ই জুলাই, ২০২১ ।
Comments